উদিসা ইসলামঃ একেকটা বছর শেষ হওয়া মানে যেন অনন্তে মিশে যাওয়া। চলে যাওয়া সময় আর ফিরে পাওয়া যায় না। তাই আনন্দ-বেদনার মধ্যেই পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষতে কষতেই নতুন বছরে ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যয় জাগে সবার মনেই। অতীতের ব্যর্থতাকে জয় করে নতুন বছরের জন্য সবার মনে জাগে নতুন প্রত্যাশা। বিদায়ী ২০১৯ সালের সব অপ্রাপ্তি ও বেদনা ভুলে নতুন বছরে সবার প্রত্যাশা আগত বছরটা হোক শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির। স্বাগত ২০২০।
২০২০ সাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের বছর। বছরজুড়ে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি থাকবে এ বছরের প্রধান আলোচনার বিষয়। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা সভা ও প্রদর্শনী যেমন থাকবে তেমনই এসব অনুষ্ঠানে বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক, সরকারপ্রধান, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিও ব্যাপক আলোড়ন ঘটাবে দেশ ও বিশ্বজুড়ে। বাঙালি জাতির জন্য অবিস্মরণীয় বছর হিসেবে ২০২০ সালকে তুলে ধরতে এরইমধ্যে বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার যার শুরু হবে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ থেকে। এছাড়া ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে এই কর্মযজ্ঞ বছরের শেষদিকে বিশাল ব্যাপ্তি পাবে। ফলে বছরজুড়েই উৎসবমুখর সময় কাটাবেন দেশবাসী। তবে উৎসব উদযাপনের উদ্দীপনা যেমন থাকছে একইসঙ্গে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে সরকারকে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শুরু হওয়া দুর্নীতিবিরোধী অভিযানগুলো অনিষ্পন্ন থাকায় এ বছরও এগুলো আলোচনায় থাকবে বলে শঙ্কা আছে। তবে বছরের শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের সিটি নির্বাচন, যার সফলতা বা ত্রুটি রাজনৈতিক নতুন আবহ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে কী থাকছে সেই আলাপ এখন মুখে মুখে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে। অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও থাকবেন বিভিন্ন দেশের অতিথিরা। দেশের বুদ্ধিজীবী, সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বছরটি হতে পারে ভিন্নরকম সময়ের শুরুর বছর। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণের এরচেয়ে ভালো সময় আর হতে পারে না।
বর্তমানে ক্রোধের সময় যাচ্ছে উল্লেখ করে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সমাজের অবক্ষয়গুলো আমাদের স্তম্ভিত করে দিচ্ছে। কিন্তু সঠিক সময়ে প্রতিবাদটি আমাদের সন্তানেরা করে। তাদের ঘুমন্ত ভাবলে ভুল হবে। তিনি প্রত্যেককে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘তাকে জানুন, দেখুন মানুষটি এই দেশের জন্য কত কাজ করেছেন। নতুন বছরজুড়ে মুজিববর্ষ পালন মানে কেবল আনুষ্ঠানিকতা যেন না হয়। তার জীবনকে জানুন, লেখা পড়ুন, কাজে লাগাতে না পারলে নীরব থাকেন। ২০২০ সালে সরকারি দলের অনেক দায়িত্ব। এমন কিছু করবেন না যা বঙ্গবন্ধু কোনোদিন আশা করেননি। শুধু কথার কথা নয়, বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে চেষ্টা করেন। বিবেকের জায়গাটা পরিষ্কার করুন। দুর্নীতিবাজ যারা চুটিয়ে ব্যবসা করছে, তাদের নির্মূল করুন। টিআইবি আসক এদের আস্থায় নিতে হবে, কারণ এরা ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেবে। আর যারা স্বাধীনতাবিরোধী এখনও আছেন তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আয়নায় নিজের চেহারা দেখুন। বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে এদেশে রাজনীতি করা যাবে না।
এই উদযাপনের মধ্যে সবচেয়ে যে চ্যালেঞ্জটি ভাবাচ্ছে সেটি হলো দারিদ্র্য বিমোচন। উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও তা ধরে রাখা, আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্যসীমার বাইরে নিয়ে আসাই এখন সরকারের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে অভিবাসী শ্রমিক অধিকার, ভারতের এনআরসি উদ্যোগ মোকাবিলা বাংলাদেশকে এবছর নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর অর্থনীতিবিদ নাজনীন আখতার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের ক্যালেন্ডার ইয়ারের শুরু অর্থবছরের মাঝামাঝি। এসময় এসে যদি দেখি, রাজস্ব আদায়ের চ্যালেঞ্জটা বড়। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এখন পর্যন্ত যা আদায় হয়েছে সেটি আশানুরূপ নয়, এটি সরকারকে প্রচুর পরিমাণ বড় ঋণ নিতে বাধ্য করবে। যেহেতু সরকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ফলে অর্থবছরের আগামী ছয় বছর রাজস্ব আদায়ের গতি বাড়ানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি আরও বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় সময় অনুযায়ী করা প্রয়োজন, যাতে খরচের বৃদ্ধি না হয়। ক্যালেন্ডার ইয়ার শুরু হচ্ছে অর্থনৈতিক বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ৯ শতাংশ সুদের হার সরকার বাস্তবায়ন করতে চায়। তবে কেবল সুদের হারের ওপর ব্যবসা বাণিজ্য নির্ভর করে না। ব্যাংকের আয় শুধু কমানো নয়, ব্যবসার অবকাঠামো গড়ে তোলার যে চ্যালেঞ্জ সেটিতেও কাজ করা দরকার। এক্ষেত্রে ইকোনমিক জোন বাস্তবায়ন জরুরি। সব ইপিজেড যাতে খুলে দেওয়া সম্ভব হয়, সেদিকে খেয়াল করতে হবে।
২০১৯ সালে দ্রব্যমূল্যে অভিজ্ঞতার আলোকে কৃষকের ধানের দাম পেতে যেন সমস্যা না হয় সেদিকে উদ্যোগ নিতে হবে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ক্ষুদ্র কৃষকদের অল্পদিনের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। পেঁয়াজের দাম এবছরও যেন ২০১৯ এর মতো লাগামহীন না হয় সেই পরিকল্পনাটা করতে হবে। নারীদের প্রতি সহিংসতা ইস্যুতে আরও সংবেদনশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেছেন, গত যে কোনও সময়ের তুলনায় ধর্ষণ বেড়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে উদ্যোগ ও বাজেট বাড়াতে হবে।
২০১৯ সালে বছরজুড়েই অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ১ কোটিরও বেশি অভিবাসী রয়েছে। এর অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যে। গত একবছরে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছে নারী শ্রমিকদের অনেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার মনে করেন, একইধরনের চ্যালেঞ্জগুলো থেকে যাচ্ছে। এখনও দক্ষ শ্রমশক্তি পাঠানোর জন্য যে উদ্যোগ সেগুলো নেওয়া হয়নি। অপেক্ষাকৃত স্বল্পদক্ষ লোক দিয়েই কাটাতে হচ্ছে। কী ধরনের কোর্স, বাইরের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা সেসব নিয়ে পরিকল্পনা নেই। যে সেক্টরগুলোর বাইরে সম্ভাবনা আছে সেসব বাছাই করা জরুরি।
তিনি আরও বলেন, অভিবাসন ব্যয়টা বড় চ্যালেঞ্জ। সেটি কমানোর জন্য দালাল, রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি এবং অভিবাসী তিনপক্ষের যোগ আছে। এটা বিবেচনায় নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও উদ্যোগ দেখছি না। নতুন মার্কেট করা কঠিন, কিন্তু সম্ভাবনাগুলোর জায়গায় উদ্যোগ থাকতে হবে। এনআরসি ইস্যুতে বলা হচ্ছে আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কূটনীতিতে আশ্বাসের কোনও জায়গা নেই। সেটা নিয়ে আমাদের কোনও প্রস্তুতি নেই। ২০১৯ সালের এই সঙ্কটগুলো নতুন বছরেও আমাদের মোকাবিলা করতে হবে।